Thursday, 17 July 2014

অধরা (২১)


অঙ্কুর কুন্ডু

অধরা

তমসা বন্দী মাধুরী

ভিখারীর নদীর মত সাম্রাজ্যে

ওজস্বী গর্ভে ভীত তুলাদন্ডের চাপে

বিবশ হয়ে ঘষতে থাকা উথ্থিত লম্ফমান

বাঘা  বাঘা  কথার  লুটিয়ে  পড়া   কাঠগড়ায়

ক্লেদ  ঝরিয়েছিল  বহু  কুঠরির  ধোঁয়াবৃত  ঠান্ডা  ঘর

  ভগ্নাংশের   সাথে   লেপে   থাকা   দগদগে   দাগের  যোগে

   কাকের   গুঁতো   বন্ধ   করেছিল   মোষের   লাফিয়ে   লাফিয়ে  খাওয়া




পেট যেন হয় সেলাই-বিহীন (২০)


পেট যেন হয় সেলাই-বিহীন
           অঙ্কুর কুন্ডু

            
                              
                  
  
       
           অঙ্ক শিখেছি , সংখ্যা ভুলে !
          
                 
   
       
           ভাষা বলেছি , বর্ণ গুলে !
           বাংলা-ইংরেজি-হিন্দী লকারে রেখে
           পি.এইচ্.ডি-র খোঁজে নতুন ল্যাঙ্গুয়েজেস্
           ৩৮ ২৬ ৩৮ – বডি ল্যাঙ্গুয়েজ্
           চিঠির মুখে জুতো মেরে এস্.এম্.এস্ ল্যাঙ্গুয়েজ !
           মধ্যমা দাঁড়িয়ে
           বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি স্পট আইডেন্টিফিকেশনে ব্যস্ত
           শরীর সব সন্ত্রস্ত
           অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি জন্ম দেয়
          
                  
  
       
           অঙ্ক শিখেছি , সংখ্যা ভুলে !
          
                 
  
         
           ভাষা বলেছি , বর্ণ গুলে !          

আমি আমাকে জানি (১৯)


                             আমি আমাকে জানি
                                          অঙ্কুর কুন্ডু

       প্রখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক অভিজ্ঞতাবাদী জন্ লক্ ছিলেন ‘ট্যাবুলা রেজা’-র প্রবর্তক ৷ এই ‘ট্যাবুলা রেজা’ কথাটির অর্থ হল – ‘জন্মের পরে শিশুদের মন থাকে অলিখিত পরিষ্কার সাদা কাগজের মতো বা স্লেটের মতো’ ৷ এরপর থেকেই শুরু হয় কাটাকুটি খেলা , সাদা শূন্যস্থানকে রঙ্-বেরঙের ঘটনা দিয়ে ভর্তি করার খেলা ৷ সমস্যাটা অঙ্কুরিত হতে শুরু করে ঠিক এই সময় থেকেই ; কারণ , মানুষের মন থেকে এই শূন্যস্থান পূরণের মতো ঘটনার অবলুপ্তি ঘটেনা , কোনও রবার দিয়ে তা মোছা যায়না অথবা মনের মনের মধ্যে ‘ডিলিট’ অপশন্ থাকেনা ; ফলে সেগুলি মনে থেকে যায় লুপ্তপ্রায় অঙ্গরূপে ৷ এবার প্রশ্ন হতে পারে যে , মনে থেকে যাওয়া সকল ঘটনা তো নিরপরাধ হয়না , অপরাধমূলকও হতে পারে ; নিরপরাধ ভালো ঘটনা মনকে উচ্চাসনে উন্নীত করে , অপরাধমূলক খারাপ ঘটনা তাহলে মনের মধ্যে বাসা বেঁধে কী করে ? এর দুটি ঊত্তর হতে পারে ৷ এক, সামাজিক মূল্যবোধের মাধ্যমে খারাপ ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে এর তথাকথিত সুফল ও কুফল সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হয়ে ভোকাল কর্ডকে টোকা দেওয়া , যাতে সেই খারাপ ঘটনাগুলির বিরূদ্ধে সোচ্চার হওয়া যায় ৷ দুই, সামাজিক মূল্যবোধকে অবচেতনায় কারারুদ্ধ করে ভোকাল কর্ডকে টোকা না দিয়ে ,দেহের শিরা-উপশিরায় ঐ অপরাধকে ছড়িয়ে দেওয়া , এবং এই সবকিছুই থাকে সৃষ্টিশীল মানুষের হাতে ৷ এভাবেই মানুষ বিবর্তিত হয় ‘অপরাধী’ ও ‘প্রতিবাদী’ চরিত্রে ৷

       আমাদের একটি সহজ সমীকরণ বুঝতে হবে , বলা ভালো, যুঝতে হবে ৷ কারণ বর্তমান সমাজ ‘বুঝে এগিয়ে চলা’-র বদলে ‘না বুঝে ভেসে চলা’ পদ্ধতিতেই বিশ্বাসী ৷ এইজন্য আমি গ.. খর্বিত , কারণ আমি মানুষ ! চেতনা , কন্ঠ ও স্বর সামাজিক মূল্যবোধ প্রদর্শনের তিনটি স্তম্ভ ৷ কারও চেতনা ১৮০ডিগ্রীতে থাকে , কারও আবার -১৮০ডিগ্রীতে –তবে থাকে অবশ্যই ৷ চেতনা যখন কন্ঠকে সুড়সুড়ি দেয় , তখনই উৎপন্ন হয় কন্ঠস্বরের ৷ তবে সেই কন্ঠস্বর যে সর্বদা চেতনারই হবে , তা নিঃসন্দেহে বলা যায়না , এই ব্যাপারে পরে আলোচনা করব ৷ প্রথমে জানা যাক্ , ‘চেতনার কন্ঠস্বর’ বলতে কি বোঝায় ! অধিকাংশেরই উত্তর হবে প্রতিবাদ ৷ কিন্তু চেতনার কন্ঠস্বর সর্বদা প্রতিবাদ হয়না , কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবাদ বাদ হয়ে যায় ৷ উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক , যখন স্বামী তার স্ত্রী-র সাথে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হয় তখন সেই মুহূর্তের প্রতিটি ভাঁজে চেতনা জড়িয়ে থাকে , এবং তারই কন্ঠস্বররূপে জন্ম নেয় এক শিশু, যে কিনা আগামী সমাজে মূল্যবোধের প্রতীক ৷ এই কন্ঠস্বরটি সমাজের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়বে নাকি ফেরত আসবে কোনো প্রতিধ্বনি হয়ে , তা সময় ঠিক করবে ৷ অর্থাৎ সেই শিশু বড়ো হয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে  , নাকি দিনের শেষে নিজের আখের গুছিয়ে বাড়ির দোরে ছিটকিনি তুলবে , তা পরবর্তীকালে বিবেচ্য এবং তার ওপরেই নির্ভর করবে এই ভবিষ্যত আদতে ‘বেণুবনে মুক্তো ছড়ালো’ নাকি নতুন মুক্তোর সন্ধান দিল ! অতএব , সামাজিক মূল্যবোধ আহরণ প্রক্রিয়াটি মন্থর এবং সময় ও যোগ্যতাসাপেক্ষ ৷ এটা কোনো স্বপ্ন নয় যে , ঘুমালাম , স্বপ্নে দেখলাম মূল্যবোধ দরজায় দাঁড়িয়ে এবং দু’মিনিট পরে পেয়ে গেলাম , ঘুম ভাঙলো , ভুলে গেলাম ৷ সামাজিক মূল্যবোধ আহরণ প্রক্রিয়াটি একটা সুপরিকল্পিত সফল সিনেমার মতো ; যার শ্যুটিং চলল অনেকদিন ধরে , তারপর এর দৃশ্যায়ন হল , দর্শকরা খুশি হল , ২৫-৭৫-১০০দিন চলার পরেও মানুষজন সেই সিনেমাকে আগামী বেশ কয়েকবছর মনের মণিকোঠা থেকে সযত্নে স্মৃতির চিলেকোঠায় তুলে রাখলো ৷ চেতনার কন্ঠস্বর দু’রকমের হতে পারে  -অপর্যাপ্ত জীবন এবং অপরিমেয় জীবন ! হঠাৎ কন্ঠেই আটকে যেতে পারে , আবার মানুষের মনে আটকে যেতে পারে ! ‘কেউ কথা রাখেনি’র আক্ষেপ থাকতে পারে , আবার ‘রূপালি মানবী’ হাত ধরতেও পারে !

       এবার একটু বাস্তব সমাজে চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বক চালনা করা যাক ৷ কবিগুরুর ‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন’-এর অপব্যবহার যে আমাকে এভাবে করতে হবে , তা স্বপ্নেও ভাবিনি ৷ গন্ডগোলের সূত্রপাত ক্ষুদ্রতায় ৷ পাড়ার এক মদ্যপ সন্তান তার বাড়ির উঠোনে নিজের মা-কে বিনা কারণে বেধরক মারছে ৷ সেই মা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে ৷ কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না ৷সবাই নিজেদের বাড়ির ছাদে ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু’-চারটে ‘আহা-উহু’ হাঁক ছেড়ে ব্যাপারটাকে উপভোগ করছে ৷ তারপর আগামী দু’দিন পাড়ার প্রতিটা বাড়িতে ঐ ঘটনা নিয়ে চর্চা হতে হতে চচ্চরি তৈরী হয়ে গেল ৷ হঠাৎ সেই মদ্যপ ছেলেটি সামনের বাড়িতে ইঁটের টুকরো ছুঁড়লো ৷ সেই বাড়ির লোকেরা রে-রে করে ছুটলো তাকে মারতে ৷ অথচ ছেলেটিকে সামনে পেয়ে মুখেই বকম্-বক্ করে তাকে ছেড়ে দিল ৷ যদি এটাকে সামাজিক মূল্যবোধ বলি , তবে স্বার্থপরতা কাকে বলে ! অথচ এধরনের মানুষেরাই একত্রিত হয় যখন কোনও একজনকে ‘চোর সন্দেহে’ গণপ্রহার করার প্রয়োজন হয় ৷ যদি একে চেতনার কন্ঠস্বর বলা হয় , তবে ‘দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার’ কাকে বলে ! চারিদিকে ইদানীং রব উঠছে- ‘সমাজে নারীদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে’ ৷ আমি একজন পুরুষ ; একটা প্রশ্ন করতে চাই –পুরুষ সমাজ কি তবে ঘরে বসে প্রসব-যন্ত্রনা সহ্য করার উদ্দেশ্যে বসে থাকবে ? কেন শুধু নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে ! যে সমাজে একজন ছাত্র ‘ফেমিনিজম্’ নিয়ে কফি হাউসে টেবিল চাপড়াচ্ছে , ভার্জিনিয়া উলফ্-এর নারীর অধিকার সম্বন্ধীয় উদ্ধৃতি মুখস্থ করছে , “সেকেন্ড সেক্স”-এর আলোচনায় মেতেছে , সে এখনও কেন নিজের প্রেমিকাকে সন্দেহজনক প্রশ্ন করে ? নিজের প্রেমিকাকে অন্য বন্ধুর (পুং) সাথে ঘুরতে দেখলে , ছেলেটি কেন ‘রি-অ্যাক্ট’ করে?
কেন সে রাত্রিবেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে পর্ণোগ্রাফি নিয়ে ব্যঙ্গ করে ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে , তবে ‘ডিপ্লোম্যাসি’র সাহায্য নিয়ে ! আর এই মুহূর্তের ‘ব্রেকিং নিউজ্’ ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানি নিয়ে নাই বা বললাম ৷ এখনকার বেশিরভাগ লেখকদের লেখা পড়লেই পাওয়া যাবে ধর্ষণাতীত উলঙ্গ ও অপ্রয়োজনীয় বিবরণ ৷ অপরাধী ও মিডিয়ার পরে যদি এই ঘটনাগুলিকে কেউ ‘ক্লিশে’ করে , তবে তা হল এইধরনের লেখকগোষ্ঠী ৷ যদি এই ক্লিশেই তাদের চেতনার কন্ঠস্বর হয়  , তবে কবিগুরুর ভাষায় তাদের বলতে হয়-
                           ‘হায় রে নির্বোধ নর ,        কোথা তোর আছে ঘর ,
                                           কোথা তোর স্থান !
                           শুধু তোর ওইটুকু           অতিশয় ক্ষুদ্র বুক
                                           ভয়ে কম্পমান ৷’


       পরিশেষে কিছু শব্দ বাঁচিয়ে রেখেছি ‘জ্ঞান’ বিতরণের জন্য ৷ আগেই সূত্র দিয়েছিলাম যে , কন্ঠস্বর সর্বদা  শুভ চেতনাময় নাও হতে পারে ৷ চেতনার বৈশিষ্ট্য কি ? উইলিয়াম্ জেমস্ তাঁর “প্রিন্সিপলস্ অফ্ সাইকোলজি” গ্রন্থে চেতনার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন ৷ তাঁর মতে, “মৌলিক মানসবৃত্তি নিছক চেতনা নয় , এই চেতনা বা ঐ চেতনা নয় , তা হল আমার বা তোমার চেতনা ৷ চেতনা মাত্রই অহংকেন্দ্রিক ৷” চেতনা থাকে ‘আমি চিন্তা করি , আমি অনুভব করি , আমি স্মরণ করি’ –এভাবে ৷ অতএব সর্বাগ্রে যদি ‘আমি’ থাকি , তবে আমার মূল্যবোধ কেন তলানিতে থকবে ! চেতনা কখনওই শৃঙ্খল নয় , এটি একটি প্রবাহ ৷ আমাদের উচিত এই প্রবাহের সঠিক ধারাকে সচল রাখা ৷ মনোসমীক্ষক ফ্রয়েডের মতানুযায়ী , ভাসমান তুষারস্তূপের ১/১০ভাগ সাগর জলের ওপরে থাকে এবং বাকি ৯/১০ভাগ জলের নীচে থাকে , তেমনই মনের অল্প অংশ চেতনস্তরে প্রকটভাবে প্রকাশ পায় এবং অবশিষ্টাংশ ‘নির্জ্ঞান’-এ আচ্ছন্ন থাকে ৷ অতএব , আমাদের চেতনার জায়গা যখন কম , তখন তার ছাপ একটু বৃহৎ আকারে আটকে যাওয়া উচিত এবং একটা সুন্দর ধারণা আগামী মানুষজনের মনে সঞ্চার করা উচিত !

       একটি পিঁপড়ে আকারে এত ছোট যে , সে আঘাত পেলেও তার আকুতি আমাদের কানে পৌঁছায় না ; কিন্তু আমরা তো মানুষ –সুমহান জীব , আমরা হয়তো পারি আমাদের চেতনার কন্ঠস্বরের মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধের উদাহরণ তৈরী করতে ! নাহলে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শেক্সপিয়ার-এর কথানুযায়ী আমাদের অবস্থা হবে-
              ‘লাইফ্ . . . ইজ্ আ টেল্ টোল্ড্ বাই অ্যান্ ইডিয়ট্ , ফুল্ অফ্ সাউন্ড্ অ্যান্ড্ ফিউরি ,
              সিগনিফায়িং নাথিং ৷’
-একটা লক্ষ্য থেকে যাবে চিরদিন :
প্রতিটা মানুষের জীবন কুড়িয়ে পাওয়া ৷ প্রতিটা মানুষের মৃত্যু ফুরিয়ে যাওয়া ৷ চেতনাময় মূল্যবোধ শুনিয়ে দেওয়া আগামী জন্মকে ৷ আমি যদি আমাকে জানি , তবে তোমাদেরও জানবো , ভালো কিছু করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হব প্রতিদিন , নতুন করে ৷

___________________________________________________________________________________

ভেজা আাঁচল (১৮)


ভেজা আাঁচল
অঙ্কুর কুন্ডু

       কয়েকমাস আগেও ছেলেটির মুখের কাছে মা নিজের বুক এগিয়ে দিলে , সে খুব একটা বুকের দুধ খেত না ; ছেলেটির বয়স মাত্র এক বছর দুই মাস ৷ অভাবের সংসার , তাই বাইরে থেকে দুধ কেন অসম্ভব ৷ মাঝে-মাঝেই শরীর খারাপ হত তার ৷ বাপ-মরা ছেলেটি যখন জন্মেছিল , ডাক্তার তাকে ‘অস্বাভাবিক বাচ্চা’ আখ্যা দিয়েছিলেন ৷ অশিক্ষিতা মা এতে আনন্দ বা দুঃখ কোনওটাই পায়নি ! ফুটো ছাউনির ঘরে ও ফিনফিনে শাড়ি পরা মা-এর কাছে ‘পদ্মবিভূষণ’ ও ‘অস্বাভাবিক বাচ্চা’ সমান ৷
       গত দু’দিন থেকে ছেলেটি জ্বরে ভুগছিল ; মা ঠাঁই বসে আছে ছেলেকে কোলে নিয়ে ! আঁচল ভিজিয়ে বারবার ছেলের কপালে দিচ্ছে ; ছেলের মুখের সামনে রাখা আছে খোলা বুক ৷ কয়েকঘন্টা আগে থেকে ছেলে একবারও তা ছোঁয়নি ৷ জ্বরের গরম শরীর ঠান্ডা ও নিথর হয়ে গেছে ৷ তাও ভেজা আঁচলে মুখ চেপে মা ছেলেকে কোলে নাচাচ্ছে ও গুনগুন করছে “ছেলে ঘুমালো . . .” ৷