Saturday, 9 August 2014

কুয়োর পাশে রোম্যান্সের গারবেজ্ (৩০)


কুয়োর পাশে রোম্যান্সের গারবেজ্
অঙ্কুর কুন্ডু

                      মেঘভর্তি জানালার ফাঁকে দুপুর এসে রোদ দিয়েছিল কয়েকবার
                                    বিশেষতঃ (৩৩নং) উপপাদ্যে কম্পাসের ঘুলঘুলিতে ,
                      যখন ঝিলিক মেরে নড়িয়ে দিল পেন্সিল– ছুটির ঘন্টা
                                    কান টেনে সুলগ্নাকে তুলল ৷
                      স্কুলের গন্ডির ওপর যতটুকু মেঘ ছিল ফাঁকা আকাশে
                                    তারা চারিদিক আঁধারে ঢেকেছে ৷
                      মেখেছে কিছু চোরকাঁটা ওড়নায় –জঙ্গল পেরিয়ে যখন সুলগ্না
                                    কুয়োর পাশে ভেসে দাঁড়াল ৷

                      আজ সাত বছর পরে ,
                      সুলগ্না আরও দূরে যখন চিঠি মারফত কথা ছোঁড়ে -
                      প্রেম বলে কিছু নেই ,
                      কেবলই শব্দগুলো দুম্-দাম্ পাপড়ির মত খসে চোখের পাশে ৷
                      জানিনা কখন রেণু মেশে ;
                      না কেশে এক বৃদ্ধা লাঠি হাতে ভিক্ষা করে
                      ফুলে সাজানো ঠাকুর নিয়ে ,
                      কখনও ডাক্-টিকিট না সেঁটে পাঁচ টাকা দিয়েছ তাকে ?

                      ধার ঘেঁষে চোখ খুললে শুধুই প্রেমের কথা ছড়িয়ে
                                    কুয়োর খসখসে খোলা গায়ে ৷
                      সুলগ্না লজ্জায় যতটুকু চোখ খুলেছিল- দেখেছে নগ্ন শরীর
                                    স্কন্ধকাটা হয়ে আটকে আছে
                      ঐ খড়খড়ে সিমেন্টের গাঁথনি করা কুয়োর ছিদ্রান্বেষী বুকে
                                    কুকুর , বিড়ালের পেচ্ছাব শুঁকে ৷
                      কুয়োর জলে সুলগ্না দেখেছিল এক ওড়না কিভাবে পচেছে
                                    অপরটা গলায় যত্নে আছে !

                     

                      ওড়নার চরিত্র বদলে গেছে ,
                      সে এখন জায়গা হারিয়ে তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকে ,
                      সুউচ্চ হিমালয়ের চূড়া এখনও
                      দাঁড়িয়ে আছে ; কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে সুলগ্নার উন্মুক্ত বুকের মত ৷
                      বাতাসের সাথে এখনও ওড়ে
                      সাত বছর ও কয়েক ঘন্টা আগে পোড়া দেশলাইয়ের গন্ধ
                      রাঙা চোখ মেলে ধরে
                      যা স্তব্ধ করতে চায়- তা শহুরে রস্তর আনাগোনা ৷

                      সিদ্ধিগাছের ফাঁকেই জ্বলছে লিপস্টিক মাখা শেষ সিগারেট ,
                      ধোঁয়া গিলে পুড়েছে পাতা ,
                      ‘+’-এর চাপে পড়ে কিছু হতভাগা শেয়ার করছে অনামিকা !
                      অহমিকার স্বভাবে কিছু নাম
                      জলে পড়া কিসমিসের মত ফুলে উঠেছে- তারা শাহজাহান , মুমতাজ ৷
                      কিছু নাম বৃষ্টির ঝাঁঝ !
                      কুয়োর ধার বেয়ে শ্যাওলাগুলো যতটুকু উঠবে ভেবেছিল , তারা
                      ইটের আঁচড়ে থমকে গেছে ৷

                      এখন প্রতিটা রাত বড় ,
                      অপসূর ও অনুসূরের হিসেব ভূগোলের পাতায় হোঁচট খাচ্ছে ,
                      তোমার শরীরে আদর দিয়ে
                      অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াই আয়নার সামনে , কখনও সমান সামনে
                      তোমার ওড়না এবং তুমি !
                      আদতে আমি মানিকতলার ত্রিমুখী রেলব্রীজের তলায় দাঁড়িয়ে ভাবি
                      কোনটা ধরে পৌঁছাব আর
                      কোন লোম ঘাম ফেলে ফুরফুরে হাওয়ায় উড়ে যাবে !

                     




                      কুয়োর কিছু দূরে যে পাঁচিলটা ঝোপের মাঝে হারিয়েছে
                      তার উপরেও ভয়ডরহীন শরীর
                      উঁকি মারছে ; কিছু অনামুখো ছেলে ও হতভাগী মেয়ে
                      গা ঘেঁষে আদর চাইছে -
                      নিতম্বগুলোর এক পশলা শক্তভাবে বসে , এবং এক পশলা
                      হাওয়ায় ভেসে ক্রমশঃ অসাড় ,
                      কুয়োর ধারে পেচ্ছাবের গন্ধ ক্রমশঃ জটিল ও রহস্যময়ী
                      ওটা কোন্ ধরনের কুকুর !

                      সুলগ্না , দু’দিন পরে আসব
                      তোমার কাছে ; এখন একটি কুয়োর ধারে বসে খসড়া বানাচ্ছি ৷
                      কুয়োর জলে তাকিয়ে ছিলাম
                      ঘন্টা দু’য়েক ; জলের বদলে ইঁট আর পাথর , একটা
                      আবছা কাপড়-কুচিও আছে ,
                      রংহীন , মেদহীন ; আর গন্ধটাও আছে বুনোফুলের –
                      তোমার জন্য ওড়না কিনেছি -
                      কারুর দিকে না চেয়ে গলায় নিও –রোম্যান্সের টুকরো !


                     
                     
                     
                     






­হেল-মেট (২৯)


Tuesday, 5 August 2014

তোমার উচ্ছিষ্ট আমার প্রেম (২৮)


অস্তিত্বের শেষ বিজিটোন (২৭)


অস্তিত্বের শেষ বিজিটোন 
অঙ্কুর কুণ্ডু

       বারো বছরের রুম্পা অনেক কষ্টে খাটের নীচ থেকে হারমোনিয়ামটি টেনে আনার চেষ্টা করল , কষ্ট হচ্ছে খুব ৷ হারমোনিয়ামটির সাথে মাকড়সার জাল ও ঝুল জড়িয়ে যেন তার ওজন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে যদিওবা ঝুলের ওজন খুব কম হলেও , রুম্পার মনের ওজন যেন আরও কমে গেছে ! অথচ তাকে গাইতেই হবে ৷ আজ তার জন্মদিন ; তার মা বায়না করেছে যে মেয়েকে গান গাইতে হবে , অন্ততঃ একটা. . . ! কিছুক্ষণ বাদেই টানা তিনবছর পরে রুম্পার কন্ঠে তান শুনতে পেয়েই মা-এর চোখের কোণটি চিকচিক করে উঠল ৷ কিন্তু ঐ আনন্দাশ্রুর স্থায়ীত্ব খুবই কম ; তানের পর মেয়ে যখন স্বরতান ধরলো , তখনই সে হাঁপাতে শুরু করল ৷ গতকাল সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি , এইরকম শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল , মাঝে-মাঝেই হয় !

        ক্লাস থ্রি-তে রুম্পা যখন প্রথমবার গুনগুন করেছিল , তখনই রুম্পার মা ও বাবা ওকে এই হারমোনিয়ামটি কিনে দিয়েছিল ৷ একবছর সে গানও শিখেছিল ৷ মিহি স্বরে যখন ও গান শুরু করত তখন ওর মা-বাবা পাশে বসে সে মুগ্ধতায় সে গান শুনত ৷ পাশেই খেলা করত ছোট্ট ভাইটি ৷ ক্লাস ফোরের মাঝামাঝি সময়ে এমনই এক জন্মদিনের পরের সকালে রুম্পা উঠে অপেক্ষা করছে যে কখন প্রতিদিনের মত ওর ভাই-এর মুখটি প্রথমে দেখবে ! রুম্পার একটি আলাদা ঘর ছিল ৷ ওর ভাই মা-বাবার মাঝেই ঘুমাত ৷ সেদিন রুম্পার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছিল ৷ দরজা খুলতেই চারিদিকের একটা সুগন্ধ যেন তাকে গিলতে এল ৷ চোখ খুলে প্রথমে সে ভাই-কে দেখল ৷ তবে ভাই-এর সাজানো মুখটি দেখেই তার গলাটি বুজে এল ৷ ভাই নেই , ভোরেই মারা গেছে , রুম্পার জন্মদিনের পরবর্তী প্রথম সকালেই ৷ এই শোক কাটতে না কাটতেই রুম্পার মা-বাবার জীবনে আরও একটা বিপর্যয় নেমে এল রুম্পার হার্টে ফুটোর মাধ্যমে ৷ ডাক্তারেরা সময় দিয়েছিলেন দুই বছর ; কিন্তু দুইবছর অনেকদিন আগেই পেরিয়েছে ৷ তাই ওদের মনে সাহসও এসেছে ৷ এখন রুম্পা মা-বাবার মাঝেই শুয়ে থাকে ৷

        আজ রুম্পার খুব ভালো কাটলেও , জন্মদিনটি এলেই ওর ভাই-এর জন্য ওর খুব কষ্ট হয় , কারণ পরদিনই তো অনাকাঙ্খিত মৃত্যুটি. . . জন্মদিনের উপহারস্বরূপ মা-বাবার কাছ থেকে রুম্পা একটি সুন্দর টেডি পেয়েছে ৷ ও টেডিটিকে ‘ভাই’ ডাকে ৷ কিন্তু রিটার্ন গিফট্ হিসেবে গান আজ উপহার দেওয়া হল না ; আগামীকাল হবে ! টেডি থুড়ি ভাই-কে পাশে নিয়ে সে শুয়ে শুয়ে বাবার মোবাইলে খেলার ছলে ঐ মোবাইল নম্বরেই ফোন করল ; স্বভাবতই বিজিটোন ! এরপর খেলতে খেলতে হঠাৎই চোখের পাতায় সেই ঘুম নেমে এল ৷ আবার সেই সকালবেলায় মা-বাবার মাঝে তাদের শেষ অস্তিত্বটুকু নিথর হয়ে রইল , টেডিও তো আদর পেল না আর !