লেট্-ডিভোর্স
অঙ্কুর কুণ্ডু
১২ই ডিসেম্বর, এই দিনেই মিনির বাবা-মায়ের ডিভোর্স
হয়৷ তিনবছর হয়ে গেল, এই দিনটি ঘুরে-ফিরে এলেই মিনির গলা বুজে আসে, গাল মুছতে-মুছতে
ভুলেই যায় যে ওর হাতভর্তি ফোসকায় ডাক্তার জল লাগাতে নিষেধ করেছে৷ গত চারদিন ধরে এই
‘GUARDIAN’ হোমই হল মিনির বর্তমান ঠিকানা৷ মিনির যখন দশ, তখনই ও মা-বাবার থেকে আলাদা
হয়৷ ডিভোর্সের পরে মিনি বারবার ফিরে যেতে চেয়েছে মা-বাবার কোলে; কিন্তু তাদের চাহিদা
ছিল না৷ অথচ ছোট থেকেই মিনি দেখেছে তার মা বাবার মধ্যে কখনও কথা কাটাকাটি হয়নি৷ মিনিকে
কাকিমার বাড়িতে রেখে মিনির বাবা-মা ঘুরতে যাওয়ার পর থেকেই ওদের ডিভোর্স৷
বাবা-মায়ের ডিভোর্সের পরে মিনি কাকিমার বাড়িতেই
থাকতে শুরু করে৷ বাইরের বাজার ও রেশন থেকে শুরু করে ঘর মোছা ও বাসন মাজা প্রায় সব কাজ
মিনিকেই করতে হত৷ এত কাজের মধ্যে থেকে মিনির পড়াশুনা আর এগোয়নি৷ এই তো কিছুদিন আগে
খুড়তুতো ভাইয়ের বইগুলো উল্টে-পাল্টে দেখছিল বলে কাকিমা হাতের তালুতে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা
দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল৷ কাকিমার বয়স প্রায় পঞ্চান্ন, বেরোনোর আগে মিনি যন্ত্রণা
সত্ত্বেও কঁকিয়ে বলেছিল “কাকি, তুমি তো এত কাজ একা করতে পারবে না, আমি আর কোনোদিন বই
ছোঁব না, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও৷” মিনির ‘কাকি’ একজন নতুন কাজের লোক পেয়ে গেছে,
যে মিনির থেকে বড়ো এবং ওর থেকে বেশি কাজ অনেক ভালোভাবে করতে পারে৷
মিনির
স্বপ্ন ছিল বড়ো হয়ে ডাক্তার হবে এবং মায়ের বাতের ব্যথাটা সারিয়ে তুলবে৷ মিনি দেখেছিল
এক-দু’দিন মা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারত না৷ মিনিকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকত পেইন-কিলার খেয়ে৷
মাঝে-মাঝে মিনি মুখ তুলে দেখত, মায়ের বুজে রাখা চোখের পাশ থেকে জল গড়াচ্ছে৷ মা কখন
ঘুমিয়ে পড়ত ও কখন চোখের পাশের জল শুকিয়ে যেত, তার সাক্ষী ছিল মিনি৷ কিন্তু মাকে সারিয়ে
তোলা হল না মিনির৷ মায়ের ব্যথা তিনবছর আগেই কমে গেছে, যখন দার্জিলিঙের খাদে বাবা-মা
গাড়ি সমেত পড়ে মারা গিয়েছিল৷ ওদের এই ডিভোর্সটা মিনির তিন-চারবছরে হলে, হয়তো এতটা গলা
বুজে আসত না মিনির৷ ডিভোর্সের ডেট্ পিছিয়ে লেট্ হয়ে গেল৷
No comments:
Post a Comment