অস্তিত্বের শেষ বিজিটোন
অঙ্কুর কুণ্ডু
বারো বছরের রুম্পা অনেক কষ্টে খাটের নীচ থেকে
হারমোনিয়ামটি টেনে আনার চেষ্টা করল , কষ্ট হচ্ছে খুব ৷ হারমোনিয়ামটির সাথে মাকড়সার
জাল ও ঝুল জড়িয়ে যেন তার ওজন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে যদিওবা ঝুলের ওজন খুব কম হলেও , রুম্পার
মনের ওজন যেন আরও কমে গেছে ! অথচ তাকে গাইতেই হবে ৷ আজ তার জন্মদিন ; তার মা বায়না
করেছে যে মেয়েকে গান গাইতে হবে , অন্ততঃ একটা. . . ! কিছুক্ষণ বাদেই টানা তিনবছর পরে
রুম্পার কন্ঠে তান শুনতে পেয়েই মা-এর চোখের কোণটি চিকচিক করে উঠল ৷ কিন্তু ঐ আনন্দাশ্রুর
স্থায়ীত্ব খুবই কম ; তানের পর মেয়ে যখন স্বরতান ধরলো , তখনই সে হাঁপাতে শুরু করল ৷
গতকাল সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি , এইরকম শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল , মাঝে-মাঝেই হয় !
ক্লাস থ্রি-তে রুম্পা যখন প্রথমবার গুনগুন
করেছিল , তখনই রুম্পার মা ও বাবা ওকে এই হারমোনিয়ামটি কিনে দিয়েছিল ৷ একবছর সে গানও
শিখেছিল ৷ মিহি স্বরে যখন ও গান শুরু করত তখন ওর মা-বাবা পাশে বসে সে মুগ্ধতায় সে গান
শুনত ৷ পাশেই খেলা করত ছোট্ট ভাইটি ৷ ক্লাস ফোরের মাঝামাঝি সময়ে এমনই এক জন্মদিনের
পরের সকালে রুম্পা উঠে অপেক্ষা করছে যে কখন প্রতিদিনের মত ওর ভাই-এর মুখটি প্রথমে দেখবে
! রুম্পার একটি আলাদা ঘর ছিল ৷ ওর ভাই মা-বাবার মাঝেই ঘুমাত ৷ সেদিন রুম্পার ঘুম থেকে
উঠতে দেরি হয়েছিল ৷ দরজা খুলতেই চারিদিকের একটা সুগন্ধ যেন তাকে গিলতে এল ৷ চোখ খুলে
প্রথমে সে ভাই-কে দেখল ৷ তবে ভাই-এর সাজানো মুখটি দেখেই তার গলাটি বুজে এল ৷ ভাই নেই
, ভোরেই মারা গেছে , রুম্পার জন্মদিনের পরবর্তী প্রথম সকালেই ৷ এই শোক কাটতে না কাটতেই
রুম্পার মা-বাবার জীবনে আরও একটা বিপর্যয় নেমে এল রুম্পার হার্টে ফুটোর মাধ্যমে ৷ ডাক্তারেরা
সময় দিয়েছিলেন দুই বছর ; কিন্তু দুইবছর অনেকদিন আগেই পেরিয়েছে ৷ তাই ওদের মনে সাহসও
এসেছে ৷ এখন রুম্পা মা-বাবার মাঝেই শুয়ে থাকে ৷
আজ রুম্পার খুব ভালো কাটলেও , জন্মদিনটি এলেই
ওর ভাই-এর জন্য ওর খুব কষ্ট হয় , কারণ পরদিনই তো অনাকাঙ্খিত মৃত্যুটি. . . জন্মদিনের
উপহারস্বরূপ মা-বাবার কাছ থেকে রুম্পা একটি সুন্দর টেডি পেয়েছে ৷ ও টেডিটিকে ‘ভাই’
ডাকে ৷ কিন্তু রিটার্ন গিফট্ হিসেবে গান আজ উপহার দেওয়া হল না ; আগামীকাল হবে ! টেডি
থুড়ি ভাই-কে পাশে নিয়ে সে শুয়ে শুয়ে বাবার মোবাইলে খেলার ছলে ঐ মোবাইল নম্বরেই ফোন
করল ; স্বভাবতই বিজিটোন ! এরপর খেলতে খেলতে হঠাৎই চোখের পাতায় সেই ঘুম নেমে এল ৷ আবার
সেই সকালবেলায় মা-বাবার মাঝে তাদের শেষ অস্তিত্বটুকু নিথর হয়ে রইল , টেডিও তো আদর পেল
না আর !
No comments:
Post a Comment