ফুটপাথে থাকাকালীন অনুভবের কোনো নাম ছিল না
৷ এই বাড়ীতে এসে অনুভব খুঁজে পেয়েছে বাবা-মাকে ৷ নিঃসন্তান দম্পতিরা প্রায়শই অনাথ-আশ্রম
থেকে বাচ্চা নেন ৷ মি.-মিসেস দত্ত দম্পতির অনুভূতির কথা ঠাহর করাই যায়নি ৷ রাস্তা থেকে
আটবছরের ছেলেটাকে পরম যত্নে তুলে এনে নিজেদের সচ্ছ্বল পরিবারে জুড়ে দিলেন ৷ এই দম্পতিকে
আর কেউই ‘আঁটকুড়ে’ বলে না ; অনুভবও আর অনাথ নয় ৷ কী দারুণ ভাগ্য !
অনুভবের বাইরে যাওয়া বারণ , যদি ঘরের কেলেঙ্কারি.
. . অনুভব যখন বাইরে ঘুরতে যায় তখন মা-বাবার মাঝে পরম আদরে ওনাদের হাত ধরেই থাকে ৷
রাস্তার ছেলে বলেই কী না জানা নেই , ওর গায়ে ঘা-ভর্তি ৷ আসলে ঘরের কাজ ঠিকমত না করলে
তো মনিবরা কাজের লোকের ওপর রেগে থাকবেনই ৷ অনুভবের নতুন মা অনুভবকে একটু বসতে দেখলেই
সারা গায়ে খুন্তির ছ্যাঁকা দিতে থাকেন ৷ রাস্তা থেকে ছেলে তুলে আনার এটাই একটা বড় সুবিধা
৷ অনুভবের যখন নাম ছিল না , তখন ও রাস্তার ছেলে ; এখন ওর নাম হয়েছে, ও বড় হচ্ছে , তাই লোক. . . কাজের লোক !
গতকাল সকাবেলায় রাজু ‘মা , আসছি’ বলে সেই
যে বেরোল , আর ফিরল না ৷ মারা গেছে রাজু ৷ যদিওবা ওর মা এখনও জানে যে ছেলে নিরুদ্দেশ
৷ আগামীকাল রাজুর বয়স হত বারো ৷ জন্মদিনের আগেই মৃত্যুর ঘটনা হামেশাই ঘটছে ৷ কিন্তু
এইবারের জন্মদিনটা রাজুর কাছে আলাদাই হত ৷ কারণ তিনবছর বন্ধ থাকার পরে দুইমাস আগেই
রাজুর মায়ের কর্মস্থল –পুতুল তৈরীর কারখানাটা খুলেছে ৷ ইচ্ছে ছিল এই জন্মদিনে ছেলেকে
একটা জামা দেবে , সেইজন্য কিছু টাকা সরিয়েও রেখেছিল রাজুর মা ৷ কিন্তু তা আর হল কই…
ইতিমধ্যেই সাদা চাদরে মুড়ে শোওয়া রাজু ঘরের সামনে চলে এল ৷
রাজুর মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলের সামনে
বসে পড়ল ৷ রাজু ট্রেনে কাটা পড়েছে ৷ হঠাৎই রাজুর মা হেসে উঠল , মাথা কাজ করছে না যে
তা নয় ; আসলে যখনই রাজুকে ওর মা পড়তে বলত ও এইভাবেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকত ৷ রাজুর
মা জানেও না যে তার জমানো জন্মদিনের টাকায় অজান্তেই রাজুর বাবা ফুল-কাঠ-চাদরের আয়োজন
করেছে , এবার যে…
শ্রীরাধা আমার থেকে মাত্র দুই বছরের বড় ৷
বয়স নিয়ে আমাদের কোনোদিনই অসুবিধা হয়নি ৷ ও জানে যে আমি ওর শরীরটাকে খুব ভালবাসি ,
তা বলে কখনও ও আমাকে পার্ভার্ট বলে গালিগালাজ করেনি ৷ শ্রীরাধা কথা বলতে পারে না ,
একটানা হেসে যেতে পারে , ইশারা করে আমাকে কাছে পাওয়ার জন্য ৷ ওর সব ইশারাই আমি বুঝতে
পারি , অন্য কেউ বুঝবে না , হয়তো ওর সাথে এতদিন আছি বলেই… ও মাঝে-মাঝেই চুপ করে আমার
সূক্ষ্ম ও লম্বা আঙুলের ছোঁয়া পেতে চোখের সামনে নিজের খোলা পিঠ মেলে দেয় ! সকলের কাছে
ওর খোলা পিঠ যৌনতার পাঁচিল মনে হলেও , আমার কাছে তা মৌনতার মিছিল !
আমার যখন উনিশ , তখন শ্রীরাধাকে প্রথম দেখি
৷ শ্রীরাধা কাঁদলে আমার কষ্ট হবে , তাই কাঁদে না ৷ ও এতই শান্ত , কখনওই আমাকে ছেড়ে
যাওয়ার কথা বলে না ৷ আমার লেখা পড়ে শোনালে শ্রীরাধা সাদা চাদরের পিঠে পিঠ রেখে তা শোনে
৷ শ্রীরাধা কাছে ডাকলে , আমি আঙুল-জল-রং-তুলি নিয়ে সাদা ক্যানভাসে আঁকা ওর দেহের রং
গাঢ় ও হালকা করে দিই !
বাংলা নাটকের একাল-সেকাল যদি এড়িয়ে যাই , তাহলেও
বলতে বাধ্য হব যে মঞ্চে বর্তমানকালের বাংলা নাটক বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে
একজন রক্তমাংসের মানুষের জীবন বরাবরই হোঁচট খেয়েছে , যখনই তার সাথে তুলনায় আসে কল্পিত
ও পরিকল্পিত ঐতিহাসিক চরিত্র ৷ এইসকল চরিত্রের কাছে যাঁরা হেরে যান বা যাঁদের হারিয়ে
দেওয়া হয় , তাঁরা কিন্তু সকলেই এই বাংলায় কোনো না কোনো সময়ে বসবাস করেছিলেন এবং এঁরা
যাদের কাছে হারেন , তারা কোনোদিনই হয়তো এই বিশ্বেই ছিল না , এরা সকলেই লেখকের মস্তিস্কপ্রসূত
এবং লেখনীর বর্ণপ্রসূত ৷ পরিবর্তনের কোনো ধারাই তো চোখে পড়ল না ; যেখানে স্বপ্নসন্ধানীর
“ম্যাকবেথ্” বহুল প্রশংসিত , সেখানে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচর্যায় “নিঃসঙ্গ সম্রাট”
তো জন্মাল এবং হারিয়েও গেল ৷ ঠিক তেমনই যখন দেবশঙ্কর হালদার অভিনীত “অয়াদিপউস্” স্ট্যান্ডিং
ওভেশন্ পায় , তখন বাঙালীর অত্যন্ত কাছের নীললোহিত “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়” নাটকে কেন মন
কাড়তে ব্যর্থ হন ! যতটুকু হাততালি বা দর্শক এই নাটকটি পেয়েছে তার সিংহভাগটাই সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতি ও শঙ্কর চক্রবর্তীর নিখুঁত অভিনয়ের জন্য !
১১ই এপ্রিল ২০১৪ , শুক্রবার , প্রথম মঞ্চস্থ
(প্রিমিয়ার) হয় দর্শকের সামনে , “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়” নাটকটি ৷ চিরঞ্জীব বসুর লেখা
এই নাটকে “বেলঘড়িয়া হাতেখড়ি” নাট্যদলের হয়ে অভিনয় করেছেন শঙ্কর চক্রবর্তী , সোনালী
চক্রবর্তী , সুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায় , সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় , অনীক , সেঁজুতি , দোয়েলপাখি
প্রমুখরা ৷ সঙ্গীতে সুরজিৎ চ্যাটার্জী , মঞ্চসজ্জায় হিরণ ও আলোতে জয় সেন ৷ প্রথমে নাটকটি
সম্বন্ধে কিছু শোনা যাক্ -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে নীললোহিত বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত
লেখক ৷ একের পর এক মনকাড়া কবিতায় , উপন্যাসে বাংলা পাঠক-পাঠিকাদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছেন
তিনি ৷ নতুন লেখক/কবি , পত্র-পত্রিকাকে রীতিমত তিনি উৎসাহ দিয়েছেন , সংসারে একনিষ্ঠ
সাংসারিক মানুষ হয়ে সামনে এসেছেন ৷ নাটকের সবচেয়ে সুখকর দৃশ্য হতে পারত সুনীল-শক্তি
যুগলবন্দীর রসায়ন ৷ কে না জানেন যে সুনীল-শক্তি নিজেদের লেখার জগতে ছাড়াও নেশার পেয়ালাতেও
উল্লেখযোগ্য ছিলেন ৷ সন্ধ্যায় যেমন “কৃত্তিবাস” পত্রিকা নিয়ে সভা বসেছে , তেমনই মদের
আসর বসেছে , প্রতিনিয়ত তর্ক-বিতর্ক নতুন মোড় নিয়েছে ৷ সুনীল শান্ত , শক্তি মেজাজী ৷
এখানেই প্রথম ধাক্কা খেল নাটকটি ৷ শক্তি চট্টোপাধ্যায় আদতে শুধু মেজাজী ছিলেন না ;
ছিলেন যুক্তিবাদী , গোছানো অসংযত একজন মানুষ , যাঁর জীবনের সাথে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের
জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত ৷ নাটকে সেই শক্তি মাঝে-মাঝেই উধাও হয়ে যান ! মঞ্চে কেবলই ওঁর
মাতলামি এবং আদ্যোপান্ত মুখস্থ করা বুলিই যেন আওড়ে গেলেন ৷ দোয়েলপাখির মত একজন অভিজ্ঞ
অভিনেত্রীর চোখ যেন অন্যমনস্কভাবে ইতি-উতি দৌড়াচ্ছে ৷ তিনি অভিনয়টা ভালোই করেছেন ,
কিন্তু কোথাও যেন তাঁর অন্যমনস্কতা বারবার দেখা দিয়েছে ; নাহলে মার্গারেটের ভূমিকায়
তাঁকে সুন্দর মানিয়েছে ৷ হতে পারে যে নাটকের সেটি দ্বিতীয় দিন ছিল বলেই নার্ভাসনেস্
কাজ করেছে ৷ কিন্তু পেশাদারিত্বে এইসব খাটে কি ! যেখানে রিহার্সালের সময় পাওয়া গিয়েছিল
এবং প্রিমিয়ার শো উতরে দেওয়া হয়েছে ! সুনীলের ভূমিকায় শঙ্কর চক্রবর্তী –ওনাকে আলিঙ্গন
করার মুহূর্তগুলিতেও দোয়েলপাখিকে যথেষ্ট আড়ষ্ট দেখিয়েছে ৷ যাঁর নজর কাড়ার কথা ছিল তিনি
যদিওবা হতাশ করেননি ৷ প্রথম দৃশ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকায় শঙ্কর চক্রবর্তীর
‘কেউ কথা রাখেনি’ আবৃত্তি থেকে অন্তিম দৃশ্যে তাঁর চরম আবেগঘন সংলাপ –কোথাও মাপকাঠি
নড়েনি ৷ সুনীল-জায়া স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকায় সোনালী চক্রবর্তীর যতটুকু ভালো করার
দরকার ছিল , তিনি প্রায় তা সফলভাবেই করেছেন , তবে এক-এক সময় মনে হয়েছে উনি বোঝাচ্ছিলেন
যে উনি নাটকে অভিনয় করছেন , যা নাটকের বিধিলঙ্ঘন করে ৷ অন্তিম লগ্নে বিধবা বেশে যতটা
আবেগতাড়িত হব ভেবেছিলাম , ততটা হতে পারলাম না ৷ বর্তমান নাট্যজগতে সেঁজুতি নামটা খুব
উল্লেখযোগ্য ৷ কিন্তু “অয়াদিপউস্” বা “নিঃসঙ্গ সম্রাট”-এর ধারে-কাছেও এই নাটকে তাঁকে
দেখা যায়নি ৷ সংলাপ বলার সময় মনে হল যেন উনি মাঝে-মাঝেই হোঁচট খাচ্ছেন ৷ তবে ওনার প্রতি
দর্শকের আশা কিছুমাত্র হলেও বিফলে যায়নি ওনার কন্ঠস্বরে উদ্ভূত বেদনার জন্য ৷ বাকীরা
পার্শ্বচরিত্রে মোটামুটি ভলোই অভিনয় করেছেন ৷ চিরঞ্জীব বাবু তাঁর লেখায় কমিক্ রিলিফ্
ব্যবহারের চেষ্টা করলেও , তা নামমাত্র ছুঁতে পেরেছেন ; তবে সংলাপের জন্য নাটকটির প্রশংসা
প্রাপ্য ৷ তসলিমা-সুনীলের বিতর্কিত ঘটনাটিতে সব থাকলেও , প্রাণ ছিল না ৷ মঞ্চে আলোর
ব্যবহার ভালো হলেও , প্রজেক্টরের ত্রুটি চোখে পড়েছে ৷ সম্পূর্ণরূপে প্রশংসা প্রাপ্য
সুরজিৎ চ্যাটার্জীর ৷ ‘মন রে কৃষি কাজ জানো না’ , ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’ , ‘কি ঘর বানায়েছে
দেখো সাহেব কোম্পানী’-র মত দরদী গানগুলো বেশ ভালো ৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘আমাকে
টান মারে রাত্রি জাগা নদী’-তে সুরজিৎ চ্যাটার্জীর সুর বারবার শুনতে বাধ্য করে ৷
মণীশবাবুর পরিচালনায় যেখানে “ওথেলো” বিতর্ক
উস্কে দিচ্ছে শুধুমাত্র প্রেজেন্টশনের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে চিরঞ্জীব বাবু বাঙালীর
অতিপ্রিয় সুনীলকে অত্যন্ত সহজ একটি নাটকের মোড়কে রেখেও কোনো দাগ কাটতে পারল না ৷ নাটকটি
মঞ্চস্থ হওয়ার পূর্বে চিরঞ্জীব বসু-সহ অনেকেরই মত ছিল যে স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ
থেকে অনেক নতুন বিষয় জানা গিয়েছে ৷ কিন্তু মঞ্চে দেখা গেল যে সেই অজানা তথ্যগুলো কেবলই
পর্দার ওপারে আছে , চোখের সামনে নেই ৷ এখানেই প্রশ্ন ওঠে যে যেখানে ম্যাকবেথ্ বা অয়াদিপউস্
কাল্পনিক চরিত্র হয়েও চোখ কাঁপাতে বাধ্য করে , সেখানে অন্তরের নিকটে থেকেও “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়”
নাটক কেন হৃদয়কে নাড়াতে পারল না সেরকমভাবে ? তবে কি লেখনীর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জয়-পরাজয়ের
চিত্র ? এখানেই বোধহয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ট্র্যাজিক নায়ক হয়ে ফিরে আসেন –যিনি পরাজিত
নন , তবে অপরাজিতও নন ৷ নাট্যমঞ্চে নয় , তিনি সাহিত্যের পাতায় ‘লার্জার দ্যান্ লাইফ্’
৷
কোনও প্রচেষ্টার সমগ্রটা খারাপ হয়না ; যেমন
বৃষ্টিস্নাত রোদে রামধনুর মনোরম দৃশ্য দেখা যায় , তেমনই “বেলঘড়িয়া হাতেখড়ি”র প্রযোজনায়
মঞ্চস্থ নাটক “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়” তার সংলাপ , শঙ্কর চক্রবর্তীর সুনীল-সদৃশ মেক-আপ
প্রশংসাযোগ্য ৷ সুনীলকে নিয়ে বাঙালীর মনের আবেগ এক বাতুলতার জন্ম দিতেই পারে এবং সেই
বাতুলতায় ভেসে গেলেই জন্ম নেয় সুনীলকে নিয়ে অজানা মিথ ৷ তবে যে সংখ্যক বাঙালী “সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়” নাটক দেখছেন বা যে সংখ্যক মানুষ অপ্রয়োজনীয় বাড়তি দৈর্ঘ্য দেখে বিচলিত
হয়েছেন , তাঁরা বাইরে বেরিয়ে মনে করুক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ৷ দেখবেন “বিচলিত”
রূপান্তরিত হয়ে “বিগলিত” হবে ৷ অন্ততঃ এই নাটকের নামের মাধ্যমে সুনীল স্মৃতি বিস্তৃত
হল , এই যা নাটকটির সাফল্য ৷ ‘প্রয়োজন ফুরালে জীবন শেষ’ , সুনীল তো বিস্তৃত !