ঢাকে কাঠি
বোধনের সুর তোলে না
অঙ্কুর কুণ্ডু
রোদ্দুরের বাবা
আগের মতো দূর-দূরান্তে ঢাক বাজাতে যায় না ৷ বাড়িতেই থাকে চুপচাপ , একটা কোণে. . . ঢাকের
চামড়াটাও ধীরে-ধীরে তার বুনোট হারিয়েছে ৷ রোদ্দুর যখন উচ্চ মাধ্যমিক্ দেবে , ঠিক তার
আগের বছরেই ওর বাবা ওদের টাকা রোজগারের বড়ো উপায়টা বন্ধ করে দিয়েছেন ৷ এই তো চারবছর
আগের কথা , রোদ্দুরদের বাড়িতে রেশনের চাল ছেড়ে প্রায় ২৮টাকার চাল আসত ; সাশ্রয়ের জন্য
ওরা মাত্র একবেলা খেত ৷ বাড়িতে ইলেকট্রিক্ এসেছিল ৷ লন্ঠনের আলো ও গরমে খুব বেশিক্ষণ
পড়তে পারত না রোদ্দুর ; এখন তাও ও রাত জেগে পড়তে পারে , যখন পড়ার চাপ খুব বেশি হয়
, ইলেকট্রিকের খরচ বাঁচানোর জন্য পুনরায় লন্ঠনের সামনেই পড়তে বসে রোদ্দুর ৷ বিকেলে
আগে পড়া হত না , গ্রামের লোকেরা বাবার ঢাক বাজানো শুনতে আসত ৷ এখন ও সবসময় পড়তে পারে
৷ বাবা যে পঙ্গু , তা নয় , আবার বোবাও নয় ; কিন্তু ওনার ইচ্ছা যে উনি আর ঢাক বাজাবেন
না , অগত্যা এক টুকরো জমির ওপর নির্ভরশীল হয়ে রোদ্দুরের মা-কে ঝি-গিরি করে সংসার টানতে
হয় ৷ বাবাকে আর কেউ ডাকতে আসে না , দূরে কোথাও ঢাক বাজানোর বরাত পেলেও বাবা আর কোথাও
যায় না ৷ এদিকে ঘাড়ের ওপর ঋণের নিঃশ্বাস যেন বারবার গা ছুঁয়ে যৌন সম্পর্ক চায়ছে ৷ ঢাক
যখন বাজানোই হয় না , তখন ঢাকটা রেখে কি লাভ ! তাই রোদ্দুর ঢাকটা একবার বেচতে চেয়েছিল
, কিন্তু ঢাকের অবস্থা দেখে কেউ কিনতে রাজি হয় না , খদ্দের আসে , দেখে ও একবার ধপধপ্
করে ঢাক বাজিয়ে চলে যায় ৷
আজ মহাষষ্ঠীর
সকাল ; চারিদিকে দমবন্ধ করা পুজোর গন্ধ ৷ রোদ্দুরদের বাড়ির পাশের বড়ো মাঠটিতেও প্রতিবছরের
মতো দুর্গাপুজো হচ্ছে ৷ ঢাক-কাঁসর-ঘন্টার শব্দে মাথা ঝিমঝিম্ করে ওর ৷ আগে এসব ভালো
লাগতো ৷ এই তো বছর চারেক আগের কথা –বাবা দিল্লী গিয়েছিল দুর্গাপুজোয় ঢাকিদের দলে ৷
রোদ্দুর কোনোদিন কলকাতাই চোখে দেখেনি ৷ দিল্লী শুনে বাবার কাছে বায়না করেছিল ও , যাতে
ওর বাবা ওকে নিয়ে যায় ! কিন্তু রোদ্দুরকে নিয়ে যায়নি ওর বাবা ; সে রোদ্দুরের কি কান্না
! সেইবার বাবা ফিরতে রোদ্দুর তিনদিন কথা বলেনি ৷ পরের বছর যদিওবা বাবার সাথে গিয়েছিল
মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে ৷ জায়গাটা ভালো , পাশ দিয়ে গঙ্গা বয়ে যায় ৷ বহরমপুরের মন্ডপগুলো
বিভিন্ন থিমের আদলে তৈরী ছিল ৷ সবচেয়ে বড়ো কথা , মন্ডপগুলো পাটের সুতো , কাগজ , প্লাস্টিকের
কাপ , খড় দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল ৷ ঢাকিদের দলে বাবা সেইবার নেতৃত্ব দিয়েছিল ৷ রোদ্দুর
মাঝে-মাঝেই বাবার জন্য গর্ব অনুভব করে , বাবা কি অপূর্ব বাজাত ! রোদ্দুর অনেকবার শেখার
চেষ্টা করেও পারেনি ৷ সেইবার একাদশীর সন্ধ্যায় গঙ্গায় বিসর্জন দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল
বহরমপুরের এক মন্ডপের প্রতিমাকে ৷ সকলে নাচছিল , গাইছিল , বলছিল ‘আসছে বছর আবার হবে’
৷ বাবা ঢাক বাজাচ্ছিল প্রতিমার পাশেই ৷ কিছুক্ষণ পরেই প্রতিমা বিসর্জন হয় গেল ৷ সিঁদুরে-সিঁদুরে
চারিদিক ছেয়ে গিয়েছিল ৷ সকলে গঙ্গার জল মাথায় নিচ্ছিল ৷ রোদ্দুরের বাবাও গেল একটু জল
আনতে , ছেলের মাথায় দেবে বলে. . . পরেরদিন সকালে রোদ্দুর একা ওর গ্রামে ফিরল !
তাই , ইদানীং
, ঢাকের শব্দ শুনলে রোদ্দুরের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে ৷ বারবার কানে ভাসে ‘আসছে বছর আবার
হবে’ ৷ হয় তো ! পরপর বছরগুলোতে আবার তার বাবার মৃত্যুর বছর ঘুরে আসে , সেখানে বোধন
নেই , অথচ রোদ্দুরের মা-এর সাদা থানে রং লেগে আছে , অনেক পুরোনো , তাই হলদেটে ! রোদ্দুর
ভাবে যে , ঢাকে কাঠি পড়লে সকলের মনে যখন বোধনের সুর বাজে , তখন তার ভাগ্যেই কেন এমন
! আচ্ছা , দেবী দুর্গা কি তাকে দেখলে ওই বড়ো-বড়ো চোখেই তাকায় , নাকি চোখ একটু বুজে
আসে ! আজ চারিদিকে এত ঢাকের আওয়াজ , বাবা তো নড়তে পারে একটু ! ওর বাবা বাড়িতেই থাকে
চুপচাপ , একটা কোণে , ছবি হয়ে ! রোদ্দুর একবার চেঁচিয়ে উঠল- ‘বাবা গো. . ও বাবা’ ৷
ঢাকে কাঠির আওয়াজে রোদ্দুরের চিৎকার চাপা পড়ে গেল , শরতের আকাশেও এক পশলা বৃষ্টি নেমে
এল !